মুফতি তকী উসমানী |
মুফতির দায়িত্ব তো অনেক বড় একটি দায়িত্ব। এটি এমন বড় এক দায়িত্ব যে, আল্লামা ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি একে “আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনুমোদন” বলে আখ্যায়িত করেছেন। যখন কোনো মুফতি ফতোয়া দেন, তখন তিনি যেন বাস্তবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সে ফতোয়ায় সাক্ষর করেন।
কোনো বিষয় হালাল নাকি হারাম এ বিষয়ে কেউ জিজ্ঞেসিত হলে, আল্লাহ তায়ালা বলেন,এটা তার দায়িত্ব নয় যে, তিনি নিজ থেকে এটা বলে দিবেন যে, এটা হালাল বা হারাম। এটাতো আসলে আল্লাহ তায়ালার কাজ। কোনো বিষয় সম্পর্কে আমরা যদি এটা বলে দেই যে, এ বিষয়টি শরীয়তে হালাল । তাহলে মূলত আমরা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধি হয়েই যেন তা বলি। এটাই হলো, “ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাক্ষর বা অনুমোদন করা”।
ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মত এত বড় মানুষ এ ব্যাপারে কতটা সতর্ক ছিলেন দেখুন। “ আমি ফাতহুল বুইয়ু ও তাকমিলায় ফাতহুল মুলহিম লিখতে গিয়ে চারো মাযহাবের ফিক্বহের কিতাবগুলো অধ্যয়নের চেষ্টা করেছি। যে পরিমাণ যাচাই-বাছাই , তাহকীক ও গবেষণা ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযহাবে আমি দেখেছি তা অন্য কোনো মাযহাবে আমি পাইনি”।
তার মাযহাবে যত শাখাগত মাসয়ালা আমার চোখে পড়েছে অন্য কোনো মাযহাবে আমার চোখে তা পড়েনি। তা সত্তেও ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমার সমকালীন ৭০ জন আলেম আমাকে অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত আমি ফতোয়া প্রদান শুরু করিনি। যখন ৭০ জন আলেম আমাকে এ কথা বলে দিলেন যে, এখন তুমি ফতোয়া দিতে পারো। তখন আমি ফতোয়া দেওয়া শুরু করলাম।
ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এত বড় আলেম হওয়া সত্তেও কখনো ‘আমি জানি না’ বলতে লজ্জাবোধ করতেন না। তার এক ছাত্র বলেন, একদা আমি ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে বসা ছিলাম। একের পর এক লোকজন এসে ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করছিলো। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না, আমি জানি না’। তিনি প্রশ্নের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, অধিকাংশ মাসয়ালার ক্ষেত্রে ইমাম মালেক বলেছেন ‘আমি জানি না’।
আরো পড়ুন অভিভাবক ছাড়া কি মেয়েদের বিয়ে হবে না?
অথচ আল্লাহ তায়ালা ইমাম মালেকের মাধ্যমে এত কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন যে, তা গণনা করা সম্ভব নয়। একবার এক ব্যক্তি কোনো প্রশ্নের বিষয়ে তাকে বললেন যে, এটাতো একদম সহজ একটি মাসয়ালা। তখন ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “ ফিক্বহের মধ্যে সহজ বা হালকা বলতে কোনো কিছু নেই”।
এ জন্য কোনো বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা এর উত্তর দিতে পারি না। জ্ঞানের এত বড় সমুদ্র হওয়া সত্তেও ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সতর্কতার অবস্থা ছিলো এই। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমত দ্বারা আমাদের ( সতর্কতা অবলম¦ন না করেই ফতোয় প্রদানের) এই মুসিবত থেকে হেফাযত করুন।
আরো পড়ুন গোসল করলে কি অযু করতে হয়?
বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি কোনো মুফতি সাহেবের কাছে কোনো বিষয়ে ফতোয়া জানতে চান। তখন এই প্রশ্নকারী যেন উত্তরদাতা মুফতি সাহেবকে প্রশ্নকারী নিজের ও জাহান্নামের মাঝে একটি মাধ্যম বানিয়ে নেয়।
সে এটি ঠিক করে নেয় যে, বিষয়টির কারণে আমি জাহান্নামে যাবো না। বরং এ বিষয়টিকে হালাল বা হারাম বলে দেওয়ায় এর সব দায় দায়িত্ব মুফতি সাহেবের কাধে বর্তাবে। ভুল ত্রুটি যা হবে আল্লাহর কাছে মুফতি সাহেব জবাবদিহিতা করবেন।
আব্বাজান মুফতি শফী রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে শুনেছি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান শায়বানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে, আমরা সব সময় আপনাকে চিন্তিত অবস্থায় দেখি। অন্য লোকদের যেমন হাসি খুশি দেখি আপনাকে তেমন দেখি না কেনো? ইমাম মুহাম্মাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ওই ব্যক্তির অবস্থা আর কী হতে পারে যার কাধকে মানুষ জান্নাত জাহান্নামে যাওয়ার জন্য সেতু বানিয়েছে ? ভুল ত্রুটির সমস্থ দায়ভার ওই লোকের কাধে ছেড়ে দিয়ে সেই কাধকে মানুষ সেতু বানিয়ে জান্নাত জাহান্নামে যায়?
আরো পড়ুন করোনা ভাইরাস: মহামারীর উপকারিতা
এক দিকে এই ছিলো ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে এ ইমামগণের সতর্কতার অবস্থা। ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সতর্কতার অবস্থা। ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, যখনই কোনো ব্যক্তি আমাকে কোনো মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে তখন আমি অল্প সময়ের জন্য জান্নাত ও জাহান্নামের দুটোর সামনেই পেশ করি।
আমি চিন্তায় পড়ে যাই যে, এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে নাকি জাহান্নামে নিয়ে যাবে। সতর্কতার অবস্থা ছিলো এই । অথচ আজ কাল ফতোয়া প্রদানকে এমন তুচ্ছ বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে যে, প্রত্যেকেই মুফতি সাহেব সাজতে প্রস্তুত। আর বলতে চায় এটা আমার মত, এটা আমার ফতোয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হেফাযত করুন।
আরো পড়ুন অযুহীন অবস্থায় আযান দেওয়ার হুকুম কী?
No comments:
Post a Comment